বিবর্ণ বসন্ত
– রাখী চক্রবর্তী
হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী। ভালোবাসার রশ্মি ধরে টানাটানি করতে করতে, না জানি কতজনের ঘর ভেঙে গেল বা কতজন ঘর বাঁধতেই পারল না। সে দিক থেকে ধরতে গেলে আমি ভালোবাসার টানাপোড়েন নিয়ে অত ভাবি না। আমি জানি আমি যাকে ভালবাসি সেও আমাকে নিখাদ ভালোবাসে।
চির বসন্ত আমার মনে বিরাজ করছে।আমাদের ভালোবাসা বলো বা বন্ধুত্ব যাই বলো বিপ্লব কখনওই আসবে না আমাদের মাঝে। কারণ যুদ্ধংদেহি মনোভাব আমাদের দু’জনের কারোরই নেই। ফলে সুগৃহিনী বা ঘরণী আমি হতেই পারব।নির্জন সৈকতে নিভৃতে বসে ভালোবাসার মানুষটির কথা ভাববো। দু’ চারটে কবিতা লিখবো এসব আমি ভাবিনা। দূর দূর.. যাদের ভালোবাসায় বিশ্বাস নেই তারাই ভাবুক হয়ে দু’চার লাইন লিখে ফেলে। আমার আবার ওসব আসে না।
আমার চোখে সব কিছুই সুন্দর। পড়ন্ত বিকেলে আকাশের নীলিমায় নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তখন এই আকাশের দখল নেয় আমার ভালোবাসা। তবে হ্যাঁ, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই তারাগুলো ফিসফিস করে আমার কানে বলে, “দখল নিতে চলে এলাম তোর আকাশকে, এবার চোখ সরিয়ে নে।” তখন এই ধন্দের কুলকিরানা করতে পারি না আমি। রাত বাড়ে খোলা আকাশটা ততক্ষণে বিদায় জানিয়ে দেয় আমাকে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমের দেশে চলে যাই। এখন আমার স্বপ্ন আমার সাথে আড়ি করে দিয়েছে। জোনাকির আলো, অসংখ্য নক্ষত্রের ভিড়ে এখন আমি হারিয়ে যাই না কল্পনার জগতে আমি এখন বাস করি। কোথায় ভালোবাসা? কোথায় বন্ধুত্ব? কোথায় বসন্ত?
এই তো এক বছর আগের ঘটনা..
আমাদের বাড়ির সামনের বাগানটা বসন্তের আভাস পেয়ে কি সুন্দর সেজে উঠতো। আম গাছটা মুকুলে ভরে উঠতো, আমি উপভোগ করতাম এ সব কিছু, বসন্তের আগমনে ভ্রমররা গুনগুনিয়ে যেত এ ফুল থেকে ও ফুলে। কৃষ্ণচুড়া গাছটা সবুজ লালে একাকার হয়ে যেত। পাতার সবুজ রঙ লাল ফুলের বাহারে মিশে একাকার হয়ে যেত। আমার চোখ নাকি বাহারের শেষ কথা। আমি যা দেখি তা সুন্দর হতেই হবে আমার কলেজের বন্ধুরা বলতো। বন্ধু বিহীন জীবন আমি ভাবতেই পারতাম না। তবুও ছিলাম একা..
অনেক দিন পর সেদিন কলেজে এলাম। তাও দু সপ্তাহ পর। অজানা জ্বরে বিছানা নিয়ে ছিলাম।
ডাক্তার কাকু বলল বিশ্রাম নিতে তাই, নাহলে আমি ঘরে বসে থাকার মেয়ে মোটেও না।
আমার পটল চেরা চোখ নিয়ে বন্ধুরা কতো শের শায়রি করতো। ওরা বলতো, চোখের নিশানায় কত জনকে ঘায়েল করলি আজ। আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম ওদের কথা। সুন্দরের পুজারি হয়েই তো থাকতে চেয়ে ছিলাম।বিধাতা বোধহয় অন্য রকম সৌন্দর্যের রূপ রস দিতে চেয়ে ছিল আমাকে।
আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু পলাশ। একদিন ও বললো, তোর চোখে আমার বাস রে!
আমি বললাম, ইয়ার্কি ছাড় আমাকে ভালোবাসলে বল।
পলাশ মিচকি হেসে বললো, তোর চোখে পলাশের আগুন ঝিলিক মারছে। বাড়ি যা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখ। তারপর আমার কথা ভাব দেখবি তোর চোখের মনির মধ্যে আমিই আছি।হৃদয়ে রাখ না রে আমাকে মল্লিকা। মল্লিকা রায় আমার হবু বৌ, হা হা হা..
পলাশ বরাবরই ছ্যাবলামি করতে ভালবাসে। তাই চির বসন্তের দূত বলতাম আমরা ওকে।
সেদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে পলাশের হা হা হাসির শব্দ আমার কান ছুঁয়ে সোজা বুকে এসে বাজলো, আমি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ি ফিরলাম। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে কেমন যেন মনে হল যাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি চোখে পলাশের আভা দেখা যাচ্ছে কিনা দেখি। আরে সত্যি তো আমার চোখ লাল টুকটুক হয়ে আছে। আয়নার ওপারে পলাশের মুখটা আবছা দেখাচ্ছে।
না না আর দেরি করা যাবে না। মাকে নিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার বাবু বললেন চিন্তার কিছু নেই। আই ড্রপ দিলাম। রোজ চারবার করে চোখে দেবে। এক সপ্তাহ পর চেকআপে আসবে। আমি পলাশের কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম। দু’বছর পলাশের সাথে বন্ধুত্ব। কিন্তু এরকম তো কখনও হয়নি। চোখ খুলতে পারছি না, অথচ পলাশ যেন আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, টেনে টেনে চোখ দু’টো যেই খুললাম পলাশকে আর দেখতে পেলাম না। কেন এমন হচ্ছে? পলাশকে কি ভালবাসি?
উত্তর শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ..
এক সপ্তাহ পর আবার চোখের ডাক্তারের কাছে গেলাম চোখ দু’টো এবার স্বাভাবিক হলো, মনে উল্লাস, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছি না। কখন পলাশের কাছে যাবো, এ যে আনন্দ ঘন মুহূর্ত আমার কাছে, তাই আমি মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। এবার ছোটা শুরু আমার। পলাশকে এখুনি বলতে হবে ভালোবাসি, ভালোবাসি।
মেন রোডে কখন চলে এসেছি খেয়াল ছিল না, লরিটা হঠাৎ আমার সামনে এসে গেছে টের পাইনি, “আমার হবু বৌ মল্লিকা রায়” কথাটা কানে বাজছে তো।
একটা বিকট আওয়াজ শুনলাম তারপর গেলো রে..ব্যাস
অন্ধকার চারদিকে! চোখের ব্যান্ডেজ খোলার পরও অন্ধকারের চোরা গলিতে আলোর নিশানা খুঁজতে থাকি, দিন মাস যেতে থাকলো। পলাশ এল আমাকে দেখতে। ওর হাত দু’টো আমার গালে নিয়ে বললাম, তোর চোখ দিয়ে পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর আছে সব দেখবো, নিবি তো আমায় ডেকে?
পলাশ বললো, আজ আসি রে, ভালো থাক, নেক্সট উইক লন্ডন যাচ্ছি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে।
কবিতা লিখি এখন কিন্তু লাইনগুলো বেঁকে যায়, আকাশের নীলিমায় এখন আর হারিয়ে যাইনা, নির্জন সৈকতে নিভৃতে থাকতে চাই, পলাশের কথা ভাবতে চাই। শরীর ও মনে এখনও ধুম জ্বর, আমার চোখের নিশানায় কেউ ঘায়েল হয় না আর, চির বসন্ত বিদায় নিয়েছে যে, কত বসন্ত আসবে যাবে, মন কিন্তু স্বপ্নে দেখা সেই বসন্তের জন্য অপেক্ষা করে আছে। হয়তো এ জীবনে সেভাবে চেনা বসন্তকে পাবো না শুনেছি এ জন্মের আশা আকাঙ্খা মনের এক কোনে সযত্নে তুলে রাখলে নাকি পরের জন্মে সব সব পাওয়া যায়।
দখিনা বাতাস বয় টের পাই, কার যেন পদধ্বনি শুনতে পাই, ঠিক তখনই ভাবি বিবর্ণ বসন্ত যদি হঠাৎ করে ঝলমল করে ওঠে নিভে যাওয়া দীপ যদি আবার জ্বলে ওঠে, ভাবি শুধু ভাবি আর ভাবি…